ইহুদি জাতি: ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমকালীন প্রেক্ষাপট

ইহুদি জাতি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং ধারাবাহিকভাবে টিকে থাকা একটি জাতিগোষ্ঠী, যার ইতিহাস ও সংস্কৃতি হাজার হাজার বছরের পুরনো। এই জাতির ইতিহাস ধর্ম, রাজনীতি, বিতাড়ন ও পুনরুজ্জীবনের এক চমকপ্রদ গল্প। তারা শুধু একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী নয়, বরং একটি জাতি, একটি সংস্কৃতি, একটি বর্ণময় ইতিহাসের ধারক-বাহক।

ইহুদি জাতি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং ধারাবাহিকভাবে টিকে থাকা একটি জাতিগোষ্ঠী, যার ইতিহাস ও সংস্কৃতি হাজার হাজার বছরের পুরনো। এই জাতির ইতিহাস ধর্ম, রাজনীতি, বিতাড়ন ও পুনরুজ্জীবনের এক চমকপ্রদ গল্প। তারা শুধু একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী নয়, বরং একটি জাতি


ইহুদি জাতির উৎপত্তি ও প্রাচীন ইতিহাস

ইহুদি জাতির ইতিহাস শুরু হয় প্রায় ৪০০০ বছর আগে, মেসোপটেমিয়ার উর নগরীতে জন্ম নেওয়া হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে। তিনিই ছিলেন ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের পিতৃতুল্য পুরুষ। হিব্রু বাইবেল বা তানাখ অনুসারে, ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাক ও তার পুত্র ইয়াকুবের মাধ্যমে বংশ বিস্তার ঘটে। ইয়াকুবের বারো পুত্রই ইসরায়েল জাতির বারো গোত্রের জনক হিসেবে পরিচিত।

মিসরের ফেরাউনের অধীনে দাসত্বের জীবন এবং পরবর্তীতে হযরত মুসা (আ.)-এর নেতৃত্বে সেই দাসত্ব থেকে মুক্তির কাহিনী ইহুদি জাতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়েই ইহুদিদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ "তোরাহ" লাভ হয়, যা পরবর্তীতে ইহুদি ধর্মের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথম ও দ্বিতীয় মন্দির যুগ

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে দাউদ নবী (আ.) এবং পরে তার পুত্র সোলায়মান (আ.) বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথম ইহুদি মন্দির নির্মাণ করেন। এটি ইহুদিদের ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্র ছিল। কিন্তু ব্যাবিলোনীয়রা খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে এই মন্দির ধ্বংস করে এবং বহু ইহুদিকে বন্দী করে নিয়ে যায়। এটি ছিল ইহুদিদের ইতিহাসের প্রথম বড় ধরনের ‘ডায়াসপোরা’ বা বিতাড়ন।

পরবর্তীতে পারস্য শাসক কুরুশের সময় ইহুদিরা জেরুজালেমে ফিরে এসে দ্বিতীয় মন্দির নির্মাণ করে। তবে ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা এই দ্বিতীয় মন্দিরও ধ্বংস করে দেয়। এই ঘটনার পর ইহুদিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

ডায়াসপোরার যুগ ও নির্যাতন

দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংসের পর ইহুদিরা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়েন। এই দীর্ঘ ডায়াসপোরা যুগে তারা নানান দেশের শাসকের হাতে অত্যাচার, গণহত্যা ও বৈষম্যের শিকার হন। মধ্যযুগে ইউরোপে ইহুদি জাতিকে "ঈশ্বর-ঘাতক" বলে অভিযুক্ত করা হতো, যার ফলে গণহত্যা, লুণ্ঠন, শহর থেকে বিতাড়নের মতো ঘটনা ঘটে।

বিশেষ করে ২০শতকে নাৎসি জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে সংঘটিত হলোকাস্ট ছিল ইহুদি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায়। এই গণহত্যায় ছয় মিলিয়নেরও বেশি ইহুদিকে হত্যা করা হয়।

ইহুদি ধর্ম ও সংস্কৃতি

ইহুদি ধর্ম (জুডেইজম) হচ্ছে একেশ্বরবাদী ধর্ম, যেখানে তারা একমাত্র ঈশ্বর "ইহোভা" বা "আদোনাই"তে বিশ্বাস করে। ধর্মীয় জীবন পরিচালনায় তাদের তোরাহ (ব্যবস্থাপত্র) অনুসরণ করতে হয়, যা মোশে (মুসা) নবীর মাধ্যমে প্রাপ্ত।

ইহুদিদের ধর্মীয় অনুশাসন ও উৎসব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শাব্বাথ, হানুক্কা, পাসওভার, ইয়োম কিপ্পুর ইত্যাদি উৎসব তাদের ধর্মীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের ভাষা হিব্রু, যা ইসরায়েলের রাষ্ট্রভাষা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হলোকাস্টের পর ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জোরালো হয়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র "ইসরায়েল" গঠিত হয়। তবে এটি ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে অবৈধ দখল হিসেবে চিহ্নিত হয়, যা এখনো এক রক্তক্ষয়ী বিরোধের কারণ।

ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর বহু ইহুদি সারা বিশ্ব থেকে সেখানে অভিবাসন করে। বর্তমানে ইসরায়েল বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর দেশ।

ইহুদিদের অবদান ও সমালোচনা

বিশ্ব ইতিহাসে ইহুদিরা বিজ্ঞান, সাহিত্য, অর্থনীতি, চিকিৎসা, রাজনীতি ও প্রযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আইনস্টাইন, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল মার্কস, স্পিলবার্গসহ বহু বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব ইহুদি ছিলেন।

তবে একইসাথে ইহুদি জাতিকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ও সমালোচনাও রয়েছে। অনেকের অভিযোগ—তারা অর্থনীতি ও গণমাধ্যমে আধিপত্য স্থাপন করে বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন ও দমননীতি ইহুদি জাতির প্রতি বিশ্বে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১.৫ কোটি ইহুদি রয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি বাস করে ইসরায়েলে। তারা একটি উন্নত ও সংগঠিত জাতি হিসেবে পরিচিত হলেও তাদের চ্যালেঞ্জও কম নয়। বিশ্বব্যাপী ইসলামফোবিয়া, ইহুদিবিদ্বেষ (এন্টিসেমিটিজম) আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ছে ইসরায়েল।

ইহুদি জাতি আজো টিকে আছে ধর্ম, ঐতিহ্য ও জাতিগত সংহতির কারণে। কিন্তু সামনের দিনগুলোয় তাদের টিকে থাকা নির্ভর করবে অন্যদের সঙ্গে সহাবস্থান, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধ গ্রহণের উপর।


উপসংহার

ইহুদি জাতি শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, বরং একটি ইতিহাসের ধারক, সংস্কৃতির বাহক এবং একটি রাষ্ট্রীয় শক্তি। হাজার বছর ধরে তারা অত্যাচার, বিতাড়ন ও চরম বিপদের মধ্যেও তাদের ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখেছে। তবে আধুনিক বিশ্বে তাদের টিকে থাকা ও সম্মান অর্জনের একমাত্র উপায় হলো — মানবতা, সহনশীলতা ও শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়া।

Post a Comment

Previous Post Next Post